Sunday, November 3, 2013

না হওয়া কবিতা





মলিন একটা পাতা, একা তির তির করে কাঁপছে। হেমন্তের শেষ লগ্নে আর সবার মত ও ঝরে যায়নি। ঝরা, না ঝরা যে ওর হাতে নেই। এটুকু লিখে অস্বস্তি হোলো। মনে হলো, না না, আমি আসলে বলতে চাইছি পাতাটা বড় একা। স্বজনহারা পাতাটা ভীষণ দুঃখে আছে। পৃথিবীর যাবতীয় বিষন্নতা, নিঃসঙ্গতার পাষানভার বুকে ধরে পাতাটা সজল নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নির্বাক চিৎকারে ওর নগন্য শরীরে কাঁপন ধরছে। কিন্তু সেই কথাটা কি ভাবে লিখব বুঝতে না পেরে লিখলাম মলিন একটা পাতা, একা তির তির করে কাঁপছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন মনে হয়, কেন সোজাসুজি লিখতে পারছি না কথাটা? অক্ষরগুলো কি ভাবে সাজাব ভাবতে বসি। ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা জুড়ে আসে। ঘুমকে ঘুম পাড়িয়ে জানলার পাশে এসে বসি। রাত প্রায় বারোটা। মনে হচ্ছে পাতাটার দুঃখেই দরদি আকাশ আজ সারাদিন শোকগাথা গেয়েছে, অবিরত ঝরেছে তুষার। পথ-ঘাট ভরে গেছে নিহত সারসের পালকে। আসলে প্রতিটা তুষার-ফলকে আঁকা ছিল মনখারাপের উল্কি। চোখ খুলে ঘুমোই, তাই সঙ্কেতটা বুঝতে পারিনি। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় নিষ্পত্র গাছগুলো, আসমানের দিকে তাকিয়ে গাছগুলোর দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে দূরসম্পর্কীয় নক্ষত্রগুলো। 

একটা কালো কোট পরা কুঁজো লোক ছায়ার মন্তাজ তৈরী করতে করতে বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লোকটা যেন নির্জনতার উপনাম। সম্ভবত ঠান্ডা লাগলো লোকটার, কোটের শেষ বোতামটা লাগিয়ে নিল। হাতে সিগারেট জ্বলছে, নিভছে, আবার জ্বলে উঠছে, নিভছে দেরী করে। ঘন ঘন লম্বা টান দেখে বোঝা যায় লোকটারও পাতাটার মত তীব্র দুঃখ। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে নিঃসৃত বিষাদ কুন্ডলী পাকিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে হিম বাতাসে। সে বাতাস স্পর্শ করছে পাতাটার শিরা-উপশিরা। প্রতি মুহূর্তে এক গভীর আত্মীয়তা তৈরী হচ্ছে লোকটা আর পাতাটার মধ্যে। লোকটার ক্ষতের উপশম হচ্ছে। বিষাদ সাপের খোলসের মতন খসে পড়ছে, শিরদাঁড়া ক্রমশ ঋজু, লোকটার সেরে ওঠার শব্দ তিনশ মাইল দূরে ছড়িয়ে পড়ছে ... 

ওই পাতাটার, ওই লোকটার দুঃখাবসানের একজন সাক্ষী চাই, তাই আমি এই নিশুতি প্রহরে জানলায় বসে। আর কেউ নেই, অস্বচ্ছ কাঁচের মতন দৃষ্টি নিয়ে শুধু আমি। পৃথিবীর সমস্ত নিঃসঙ্গতার শেষ পরিনামের সাক্ষ্য বহন করার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত। এই কি আমার কাজ? নাম, অর্থ, যশ, আর নারীর জন্য অহরহ এক জুয়াখেলা চলছে চারপাশে, কেউ জিতছে, কেউ হারছে। ক্রমশ সবাই দূরে চলে যাচ্ছে, প্রতিমুহুর্তে সৃষ্টি হচ্ছে হাজারে হাজারে একসাথে একা মানুষ। এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল প্রতি সেকেন্ড স্পীডে আমার দিকে ছুটে আসছে কুঁজো লোকের পাল। তার আগে আমাকে খুঁজে বার করতে হবে এমন আরো কিছু জাদু-পাতা, পাহাড়ের চুড়ো থেকে হোক, সাগরের অতল থেকে হোক, প্রজাপতি মার্কা বুক পকেট থেকে হোক...।  আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি, মুখে হিম ঠান্ডার ঝাপটা লাগে, এখন আমি কাঁদতে পারি, আমার যাবতীয় দুঃখ ভাগ করে নিতে পারি ওইরকম আরেকটা পাতার সাথে। একটা না-ঝরা পাতা, নিশুতি জানলা, অবিশ্রান্ত তুষারের মায়াবী পতন,অচেনা লোকের চোখে আঁকা চেনা শান্তির রঙ, আমাকে ব্যাকুল করে তোলে। হাত দিয়ে স্পর্শ করি বরফ। খুঁড়তে থাকি, আমাকে ও পেতে হবে ওরকম আরো কিছু পাতা। হোক না ঝরে যাওয়া। এখনো হয়ত পচন ধরেনি। আমাকে খুঁড়ে যেতে হবে। মনে হয় ঠিক পেয়ে যাব। ঠিক পেয়ে যাব। 

Wednesday, October 30, 2013

তুমি




বিস্ময় যা ও'হেনরীর, যা মৃনালের ক্রোধ, 
কলকাতা যা সুনীলের, যা অন্ধকারের রোদ 
যা নারী ঋতুপর্ণ'র, পতঙ্গের যা আলো 
যা ব্যাট সচিনের, শ্যামের যা কালো 
যা জল পালকের, যা পারস্যের রুমি   
যা ছায়া শরীরের, তাই আমার তুমি।

Monday, October 28, 2013

অবান্তর


ঘরগুলোর সবাই মৃত। কেবল একজন বেঁচে। সে আমি। আমার কি কোনো নাম আছে? 
থাকলেও আমাকে বলেনি কেউ। শুনেছি আমি অর্ধেক জানোয়ার, অর্ধেক দেবদূত।
কফি খেতে গিয়ে দেখলাম আমার চোখগুলো - ঘোলাটে, নীল নয়। খানিকটা সত্যের আভাস পেলাম। 
কথারা একা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, আমার মত, সেলসম্যান ভেবে কেউ দরজা খোলে না।
কোন দিকে যাব ঠিক জানি না,শুধু ধাক্কা লাগলে জানি নির্ঘাত দূরে যেতে হবে। 
লুকোচুরি খেলেছি অনেক ছোটবেলায়, এখন নিজের সাথে।
ভুলে যাওয়াকে ভয় পাই না, ভয় পাওয়াকে ভুলে যেতে চাই। 
সারাদিন বৃষ্টির সাথে ঘর করি, তবু ভিজি না।
দেওয়ালির পোকার মতন ফিরে ফিরে আসে মন খারাপ। 
জানি কখন ফাটল ধরে, চেয়ারের পায়ায়, পুরনো আলমারিতে, মনে। 
কবিতারা দেখভাল করে। গায়ে কাঁথা টেনে দেয়, না খেয়ে শুয়ে পড়লে ডেকে তোলে না। 
দেশলাইয়ের মত জ্বলে নিভে যাই, পুড়ি ও।  
চেনা মুখগুলোকে গোর দি আবার হোঁচট খাব বলে। 
কোনদিন আঁকিনি, রামধনু দেখাতে নিয়ে যায়নি কেউ, তাই।
জানি আমি তোমার বিপরীত, জুড়ে দিলে একটা সরলরেখা হবে।

Friday, October 11, 2013



লোক থৈ থৈ বাড়ি। জলের দরে বিকোচ্ছে দামি শব্দবন্ধ
আখেরের ফানুস, খৈ উড়ছে। হাওয়ায় বিদেশী গন্ধ।
জমি-জল-মন পুড়ছে নীচে...সোনালী ফড়িং ভেসে তুমি এল ডোরাডো-র দোরে।
শুধু ভাসা। ভাসা ভাসা আশা। সে কলম্বাসের আসা, ভুল করে। 

Tuesday, October 8, 2013

আঁধার


আলোর ক্রীতদাস নই আমি। রেজগির মত জড়ো করি অন্ধকার, তিলেতিলে। 
তুমি ব্যঙ্গ করো, এমন উজবুক কোথায় ছিলে।
সে ভেবে তোমার জন্য বড় দুঃখ হয়, কি পেলে আলোর পা চেটে?
ডেঁয়ো পিঁপড়ের মত ছড়িয়েছে রোমকূপে, টায়ারের মত পড়ে আছ ফেটে
মাথার ওপরে শুধু আতসকাঁচ ঘোরে 
চোখ, শরীর, অন্তর পোড়ে, কেবল পোড়ে
কি হবে হাপরে ভরিয়ে এমন বিষ-সেঁকো। 
বরং, একবারটি আঁধারকে ভালোবেসে দেখো।
দেখবে, কাজল সেজে দেবে ধরা
মিশমিশে শরীরে আকাশ ভরা সূর্য তারা। 
কৃষ্ণকলির আলতো ছোঁয়া নোনাধরা চুনকামে,
জীর্ণ দেয়ালে, চেনা কথা খেলবে পোষা সরগমে 
রূপকথাকে আঁচলে বেঁধে হাসবে সে যে মিটিমিটি 
কোলবালিশের পাড়ে বসে রাত পুহিও তোমরা দুটি। 
জানি, রাতের পা বেয়ে তরতরিয়ে উঠবে তুমি 
দরজায় আগল দেব, ওপারে তুমি মরমী।

Friday, September 27, 2013

বাপিকে মনে করে ...







মনখারাপের বিকেল। 
কালো মেঘের ভেতর মরা আলো। 
জানলার কাচে এলোমেলো বাতাসের মৃদু ধাক্কা। দূরে কোথাও দু একপশলা বৃষ্টির আভাস। নাকে তার সোঁদা গন্ধ। 
কাচের পাল্লা বন্ধ করার আগে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ঘরে ঢুকে এলো, 
সঙ্গে কয়েক টুকরো বর্ষণসিক্ত স্মৃতি। 


অবসন্ন জলের বিন্দুগুলো কাচের ক্যানভাসে আলপনা আঁকছে অবিরত - সরলরেখায়, বক্রাকারে। অভিপ্রায়হীন বিন্যাসে কাচের আঁচলে প্রতিনিয়ত তৈরী হচ্ছে নৈসর্গিক চিত্রকল্প। 
বাইরের দৃশ্যকল্প ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।

চতুর্দিক নীরব, নিস্তব্ধ। মুহূর্তগুলো শরীরে ধারণ করেছে মনখারাপের ফসিল।

নতজানু আমি স্মৃতিখন্ডগুলোকে একে একে স্পর্শ করি। অযত্নে লালিত স্মৃতিগুলো চেনা স্পর্শে অভিমানে নিথর। স্পর্শে ঝংকৃত হয় বেহালার বিষাদ রাগলহরীগুলো ক্রুশাকারে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের প্রতিটি গ্রন্থিতে

অবিরল কাকডাকা দুপুরে অঙ্ক কষার স্মৃতি, নির্বান্ধব কুয়াশার মাঠে গাছের মর্মর শব্দের স্মৃতি, অপরিচিতার ওষ্ঠে চকিত হাসির স্মৃতি, লাজুক গোপনীয়তার স্মৃতি।
বিগত সময় ছুঁয়ে ছুঁয়ে চোখ আটকায় বাপির দেওয়া পেনটায়। 


কালচে লাল রঙের কালি পেন। সচরাচর যে মাপের পেন পাওয়া যায় তার থেকে কিছুটা বড়। ঢাকার মাথার দিকটায় কালো জমিতে সোনালী জরির নকশা। নিচের দিকেও তাই। সোনালী সরু নিব। ঝরঝর করে লেখে। পেনটা পেয়েছিলাম ক্লাস ফাইভ এ,  ফার্স্ট হওয়ার জন্য। তখন সবে পেন্সিল থেকে পেনে হাতেখড়ি। সকাল-দুপুর হাতময় কালি। লেখার চোটে একের পর এক বঙ্গলিপি খাতা শেষ। 

জানলার ওপারে আসন্ন সন্ধার আকাশে ছবি এঁকে উড়ে গেল এক সারি রাতচরা পাখি।

পেনটাকে নয়, মনে মনে বাপিকে স্পর্শ করলাম। বাপির সস্নেহ হাত চুল ছুঁয়ে গেল।

কত নিবিড় স্মৃতি বাপিকে ঘিরে। স্পষ্ট মনে পড়ে, নিঝুম শীতের সন্ধা। আমি আর দাদা মাদুরে বসে দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করছি। ঘুমে জড়িয়ে আসছে  দু জোড়া চোখ। দরজার ওপার থেকে বাপির গলায় সোনা বলে ডাক। দাদা একছুটে সদর দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙে গলিতে। 
হিম সন্ধার অন্ধকারের ভেতর থেকে বাপি এগিয়ে আসছে, হাতে দুটো ভারী ব্যাগ। শরীরটা সামনের দিকে সামান্য নত। দাদা তাড়াতাড়ি একটা ব্যাগ বাপির হাত থেকে নিয়ে নিল। আমি দরজার ফ্রেম ধরে দাঁড়িয়ে। 
বাপি ধীরে কাছে এগিয়ে এলো, পকেট থেকে একটা চকোলেটের প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল, 
- "দুজনে ভাগ করে খাবে"।

রবিবার সকালবেলা। জ্যোত্স্নার মতো শীতের রোদ প্রশ্রয় পেয়ে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  বাপি রান্না করছে। হাফ হাতা ছাই-রঙা সোয়েটারে ঢাকা গা। একমনে কড়াইয়ের দিকে চেয়ে আছে। উনুনে অড়হর ডাল চড়েছে। তখনও গোবিন্দভোগ চালের ভাত, পাঁপড় স্যাঁকা বাকি। বাড়িময় ম ম করছে আফগানী হিং এর গন্ধ। রেডিওতে পি. সি. চন্দ্র গ্রুপের নাটক। সবাই নির্বাক পাছে নাটকের সংলাপ ফসকে যায়। আমি কড়াইশুঁটি এটা ওটা হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বাপিকে দিচ্ছি। ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে ফুলের রেণুর মতন আলগা ভালোলাগা। 

অবশ্য সব স্মৃতিই ঝিলিমিলি ছায়ার নয়, রক্তিম আভাও তাতে আছে।
তবে সে গোধূলির কোমল লালবর্ণ, দ্বিপ্রহরের ঝাঁজ তাতে অনুপস্থিত।  


তারপর বহু শীত কেটে গেছে। আট হাজার মাইল পেছনে ফেলে এসেছি সেই বনস্পতির ছায়া। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। এ ঠান্ডার দেশ। ঘাসের জাজিমে সবুজ অস্তমিত| সবুজ পাতারাও ধীরে ধীরে রঙ বদ্লাচ্ছে| পাইন আর উইলো গাছগুলোকে একা রেখে শুধু ঝরে যাওয়ার অপেক্ষা। পড়ে থাকবে কেবল শোকার্ত তুষার। 

এমন এক গভীর রাতে তারাগুলো সবে রুপোর মুকুট খুলে শুতে গেছে, দাদার ফোন এলো। বাপি চলে গেছে। তারাগুলোর কাছে। কাল থেকে বাপিও মুকুট পরবে|


এতটা লিখে দেখছি, চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা শিশির জমেছে। 
অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বাপি চলে যাচ্ছে| দূরে, দূরে, অনেক দূরে| হাতে ধরা সেই ব্যাগ দুটো। এগিয়ে গিয়ে নেবার কেউ নেই।
বাপি এতটা পথ যেতে পারবে তো,
একা।

Tuesday, September 17, 2013

দি ফলিং ম্যান কে



এক।।
আলোর ওপারে নিঃসাড়ে স্থির ওরা জনা উনিশ। 
বজ্র মুঠি ছুরি, চোয়াল-কঠিন মন নিশপিশ। 
আদিম বই মানুষ শিকারে 
বেরিয়েছে আজ কদর্য বিচারে।
মানুষকে ভালবাসবে এটুকু ভালবাসা নেই যে বুকে, 
সে  কি করে ভালবাসবে বাহাত্তর অক্ষতযোনি যুবতীকে?

দুই।।
পেয়ালা-পিরিচে কলরব, সকাল নটায় 
পৌঁছতে হবে একশ তিন তলায়।
সন্তানের করমচার মতন রাঙা দুটি গাল,
প্রেমিকার আঙুলে আঙুল ছোঁয়া ভালবাসার কুহক জাল 
তাড়াহুড়োতে পেছনে ফেলে রেখে, বাঁচবে বলে 
লোকটা ঝাঁপ দিল অমরত্বের কোলে।

তিন।।
বিজ্ঞান প্লেন পাঠায় ছায়াপথে, 
ধর্ম ইমারতে।।

Thursday, September 12, 2013

ঠাকুমার ঝুলি






কানাডা। ১২ ই  সেপ্টেম্বর, ২০১৩।


সেদিন এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যেমনটি আজকাল আর সচরাচর ঘটে না। হিংসা আর পারস্পরিক সন্দেহে দীর্ণ এই আধুনিক পৃথিবীতে যা প্রায় রূপকথায় পর্যবসিত।

মুদির দোকানের জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরব।
হেমন্তের মড়া বিকেল। আকাশময় বিষন্নতা।
গোধুলির ক্ষীন আলোকে প্রায় মুছে ফেলে আকাশে বৃষ্টি-সম্ভবা মেঘেদের দ্রুত আনাগোনা।
ঝিরিঝিরি বইতে শুরু করলো তাদের ধারা। বর্ষাক্রান্ত বিকেলে এক গাদা জিনিসপত্র নিয়ে আমি বিহ্বল। ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষারত।
একা।

অপেক্ষা যেখানে শেষ; বিরক্তি আর উত্কন্ঠার যেখানে সূচনা, সময় সেখানে স্থির।

সহসা পেছন থেকে স্নিগ্ধ কোমল অচেনা গলায় চেনা ব্যাকুলতা, "তোমার ট্যাক্সি এখনো আসে নি?"
- "না, বেশ কিছুক্ষণ হলো, এই হয়ত এসে পড়বে", উত্তরে বললাম।

বয়স আনুমানিক নব্বইয়ের কোঠায়। মমতার পরশে আলোকিত মুখ, নির্ভার মন,  থুরথুরে এক মেমসাহেব ঠাকুমা।
হাজার হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা আর একটি স্নেহ-দ্রবীভূত মুখের কথা সহসা মনে করিয়ে দেয়।

- "চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই"।
পরের দুঃখে এমন কাতর হওয়া মানুষে অন্যভস্ত, বিড়ম্বিত আমি বলি, "না, আরেকটু বরং অপেক্ষা করি..."।

কিন্তু ঠাকুমা নাছোড়বান্দা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ইতিমধ্যে ঝমঝম রূপে আবির্ভূতা। অগত্যা আমি ঠাকুমার ডাকে সাড়া দি। তার চোখেমুখে নির্মল আনন্দের আভা। আমি বাক্যহীন, স্নেহের শিকলে আনন্দ-পরাহত।

কত কি কানে আসে এই ঘোলা সময়ে। কত নীচ, হীন ভাবনা নিজেরই অগোচরে এ মনে ঠাঁই পায়। চামড়ার রঙ, বিশ্বাসের ভিত্তি, আর অর্থের গরিমা মানুষে-মানুষে লড়াই বাঁধাচ্ছে। "সেইসব শেয়ালেরা" প্রতিদিন ছিঁড়ে খাচ্ছে মানব-হৃদয়। পৃথিবীর আজ গভীরতম অসুখ, এখানে ওখানে ছড়িয়ে পোড়া কাঠ-কয়লার মতন অজস্স্র কারণ। অথচ বৃষ্টি-স্নাত সেই সন্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কালো, বাদামী, আর সাদা রঙ সব মিশে গিয়ে যে রঙ প্রস্ফুটিত হলো তা কেবল সাদা।
অমলিন অন্তরের শুভ্রতা।

ছোটবেলায় পড়েছি সাদা রঙ নাকি সব রঙের মিশ্রণ।  তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাকি সব রঙটুকু। কালোটুকু ও।
নব্বই পেরোনো অপরিচিতা বিদেশিনী ঠাকুমা সেই শুভ্রতার অকপট প্রতীকমাত্র, এমন ক্ষয়িষ্ণু দিনেও তাই তার হাতে ধরা থাকে ভালবাসার ব্যাটন।

Monday, July 15, 2013

স্পর্ধা নাম দাও



দু কলম লেখাকে কবিতা বোলো নাকো,
               ওতে ও মনে আঘাত পাবে।
দু দিনের মিতালি,
আকাবাঁকা গলিতে হাত ধরে ঘোরো
এক বিন্দু শিশির ভাগ করে পিপাসা মেটাও
এমনকি চোখের আড়ালে দু একটি ...
তার কোনো পাপ নেই, যদি তাতে তোমার পলাশের বনে ফুল ফোটে
                                                                    তবে তাই ফুটুক,

অচেনা ভুলকে কবিতা না বোলে,
                                স্পর্ধা নাম দাও।

Thursday, July 11, 2013

দুজনায়






ওষ্ঠে আতর নিয়ে বললে,
দু টাকা খুচরো দিলে ভালো হয়
দু মুঠো ঝিনুক কোড়ালে কেমন হয়?
মেঘের মাস্তুল ধরে বললাম,
মনে মনে। 

Tuesday, July 9, 2013



চিরতার মত বাঁচা 
বজ্রঝঙ্কারে চূর্ণ এমত খাঁচা 
মনে হয় বারে বারে মরি 
প্রতিবারই বাঁচি সুধা ঘট ভরি।

জাহ্নবী




কামরাগুলোয় চাঁপা ফুলের মতন থোকা থোকা দেহপল্লব।

জানলার শিকে থুতনি রেখে জাহ্নবী।
তার  
বাস মফস্সলে
করমচার মতন মুখ 
মায়ের নাম রূপলেখা, আর 
গাঁয়ের নাম হিজলডাঙ্গা।

কে যেন বলেছিল, এক নদীতে দু বার পা ডোবেনা। 

জাহ্নবীর এক শহরে সহস্রবার আসা।
তার
পিছে কাজ্লাদিঘির জল
পলাশ ডাঙার মাঠ 
কুলুঙ্গির তিনটে কড়ি, আর  
ভোরের সাঁকো আদর রাঙা।  

জাহ্নবী ভিড় থেকে একলা হয়েছে।
অন্য নদীতে নাইতে গেছে ও।

Saturday, July 6, 2013

নিসর্গ




আমলকি গাছে ঠেস দিয়ে আছ তুমি 
                            কুয়াশায় হারিয়ে গেল তিনটে প্রজাপতি 
             বেলা তার ধূসর হাত মেলে দিল
                                      সন্ধ্যের দিকে
                                     শব্দের পেছু পেছু আমি,
                                                              একা।

Thursday, June 27, 2013

রাত্রি


রুপোর মুকুট পরে,
 জ্বলে হাজার তারা। 
রাত এসেছো আমার এ হাত ধরে,
শূন্য এখন বুকের ওপর দাঁড়া।


Tuesday, June 18, 2013

একটি তস্য গলির দিনপাত





গলির মধ্যে গলি, তার মধ্যে গলি, তার মধ্যে সে এক তস্য গলি। ডাইনে  বাঁয়ে এঁকে বেঁকে  চলে গেছে গলি থেকে গলিন্তরে। পৃথিবীর সমস্ত তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র জিনিষের মনের কোনে যেমন এক ফোঁটা আশা লুকিয়ে থাকে বৃহৎ এর সাথে মেলার, তস্য গলির ও সে অসুখ হলো। একদিন তার মন করলো রাজপথ দেখতে যাবার। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তস্য গলি বেরোলো রাজপথ দেখতে।

কিন্তু, যায় কোথায়। সে যে দিকেই যায়, সে দিকেই পথ শেষ হয়ে যায়। এক পথ গিয়ে শেষ হয় গেরস্থের রান্নাঘরে, তো আরেক পথ গিয়ে ঠেকে মধ্যবিত্তের একচিলতে ভরসা, একফালি রোয়াকে। যে টুকু বা পড়ে থাকে সেটুকুর চারদিকে শুধু বাড়ি আর বাড়ি। ডাইনে বাড়ি, বাঁয়ে বাড়ি, আর সামনে বাড়ি। এ সবের মাঝে আটকে পড়ে গলির প্রাণ যখন হাঁসফাঁসিয়ে ওঠে, যখন গড়ের মাঠের ঝরঝরে হাওয়া খাওয়ার জন্য তার প্রাণ আকুলিবিকুলি করে, সে তখন ওপরে তাকায়।

সরু একখানা রেখার মতন নীলচে আকাশ। ঠিক তারই মত অপ্রশস্ত, তারই মত অকিঞ্চিতকর। স্থির হয়ে ঝুঁকে পড়ে গলির ভালোমন্দর দেখভাল করছে যেন। একচিলতে গলির একফোঁটা এক আকাশ - সবেধন নীলমনি - তাও তার দখল নিয়েছে গিলগিলে হাড় বার করা একগাদা এন্টেনা, মধ্যবিত্তের শুকোতে দেওয়া সারি সারি শাড়ি, ছোট্ট ছেলের স্কুলে যাওয়ার হাফ প্যান্ট, ডিগডিগে রোগা লোকটার রঙচটা একটা জামা, একপাটি সাদা মোজা, খুকির মাথার ফিতে, আরও কত টুকিটাকি দরকারী সব গেরস্থালি জিনিস। এরই মাঝে উঁকি মারে মিহি রেখার মত নীল আকাশ। দেখে মনে হয় ঠিক গলিরই মত নগন্য, তারই মত বান্ধবহীন, একলা। দিগন্তবিস্তৃত শহরের সেই এক টুকরো নীল আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে কেটে যায় গলির জীবন। একঘেয়ে, ফরমায়েশি, নির্জীব অস্তিত্ব।

একটুকরো হলেও আকাশের জীবনে আছে রঙের বাড়বাড়ন্ত। কোনো এক পর্দার অন্তরাল থেকে এক অজানা কেউ সেই দৈর্ঘ্যহীন প্রস্থহীন সরু রেখাটাতে নিয়ম করে ভরে দেয় বিভিন্ন রঙ। কখনো তা তীব্র  সোনালী তো কখনো বা এক ফুরফুরে মিহি হলদে।মিহি হলদের দিনগুলোতে সকাল আটটা বাজতে না বাজতে দু দিকের ছাদগুলো থেকে পুরনো তোষকের মত এলিয়ে পড়ে তুষের মতন ঝিরঝিরে হালকা রোদ। সেদিন ছোট ছেলেমেয়েগুলো স্কুল যায়না। সেদিন ঘড়িতে ন'টা বাজে না। সেদিন কাজের লোক সদর দরজার ঘুম ভাঙ্গায় না। সেদিন বাবুরা আপিস যায় না। সেদিন সারা বছর ধরে জমে থাকা মাছের আঁশ, তরকারির খোসা, মরা ইঁদুর, ফাটা চপ্পল, হলদেটে পুরনো পাতা, আর অলসতা সমস্ত সরিয়ে রেখে বাচ্চাগুলো হৈচৈ করে আসন্ধ্যা। তার শানবাঁধানো চাতালে লাল নীল বলগুলো অহরহ লাফাতে থাকে আর ছেলেমেয়ের দল স্বপ্নাবিষ্টের মত বলগুলোর পেছনে পেছনে ছোটে।

কি আশ্চর্য্য! ঠিক তখনই শ্যওলা ধরা ইট আর সিমেন্ট বিদীর্ণ করে পাথরের মাঝে চোখ মেলে এক সবুজ নবীন চারা। গলির আর তখন একা লাগে না, মনে হয় তার সব আছে, অনেক আছে, অঢেল আছে। তার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে নতুন প্রানের মৃদু কম্পন। তার ও বন্ধু আছে, তার ও যত্ন করার মানুষ আছে, তাকেও সাজাবার মত আপনজন আছে, তার ও সুখদুঃখের কথা বলার মত পড়শী আছে। এমনতর দিনে গলি আড় চোখে  তাকায় আকাশের দিকে। মেপে নিতে চায় আকাশের মনকে। সেও কি এত খুশি হলো? সেও কি জানলো যে গলির জীবনেও আছে রাজপথের বৈভব, আছে আড়ম্বরের মহিমা।  

মাঝে মাঝে সেই আড়ালে থাকা অজানা অনামা লোকটা বুঝিবা রাগ করে গলির আকাশের খাতা থেকে সব রঙগুলোকে পেন্সিলের আঁচড় দিয়ে কেটে দেয়, গলির বড় লক্ষীছাড়া দশা হয় তখন। জমা ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো হাওয়ায় এলোমেলো উড়তে থাকে। চরাচর অস্পষ্ট হয়ে যায়। নীলাভ আকাশ তখন ম্লান, ম্রিয়মান। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গলির শান দেওয়া রোয়াকের বুকে পড়ে তোলে সেতারের মূর্ছনা! সে সুরের মুর্ছনায় আর তালের গৌরবে গলির ছোট্ট একখন্ড বুকটা লাফাতে থাকে। লাফাতে লাফাতে জলের ফোঁটাগুলো কত গল্প করে গলির সাথে। তাদের পূর্ব জীবনের কথা। তারা এতদিন কোন মাঠে-ঘটে, নদে-নালায় অযত্নে পড়ে ছিল, কেমন করে তারা একে একে আকাশে জমা হোলো। কেমন করেই বা তারা নেমে এলো গলির কাছে, রাজপথের কাছে, সবার কাছে। গতকালের মলিনতা ঢেকে দিল উচ্ছল জলধারায়। ক্ষুদ্রর সাথে বৃহতের ব্যবধান মুছে দিল নির্মল আত্মীয়তায়।

তস্য গলির এ সব ব্যঞ্জনা মাথায় ঢোকে না। সে শুধু হাঁ করে অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে আর শোনে। আর ভাবে এখানেই আছে সংসারের সব কিছু। এই রান্নার গন্ধে ভরে যাওয়া গলির মধ্যেই আছে জীবনের সমস্ত রঙ-গন্ধ-বর্ণ-স্পর্শ; এই মেরুদন্ড ঝুঁকে যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যেই আছে সংসারের সারসত্য, এই শানবাঁধানো গলিতেই অস্পষ্ট অস্পৃষ্ট হয়ে আছে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড, তার নিত্যসুত্র।