Friday, September 27, 2013

বাপিকে মনে করে ...







মনখারাপের বিকেল। 
কালো মেঘের ভেতর মরা আলো। 
জানলার কাচে এলোমেলো বাতাসের মৃদু ধাক্কা। দূরে কোথাও দু একপশলা বৃষ্টির আভাস। নাকে তার সোঁদা গন্ধ। 
কাচের পাল্লা বন্ধ করার আগে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ঘরে ঢুকে এলো, 
সঙ্গে কয়েক টুকরো বর্ষণসিক্ত স্মৃতি। 


অবসন্ন জলের বিন্দুগুলো কাচের ক্যানভাসে আলপনা আঁকছে অবিরত - সরলরেখায়, বক্রাকারে। অভিপ্রায়হীন বিন্যাসে কাচের আঁচলে প্রতিনিয়ত তৈরী হচ্ছে নৈসর্গিক চিত্রকল্প। 
বাইরের দৃশ্যকল্প ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।

চতুর্দিক নীরব, নিস্তব্ধ। মুহূর্তগুলো শরীরে ধারণ করেছে মনখারাপের ফসিল।

নতজানু আমি স্মৃতিখন্ডগুলোকে একে একে স্পর্শ করি। অযত্নে লালিত স্মৃতিগুলো চেনা স্পর্শে অভিমানে নিথর। স্পর্শে ঝংকৃত হয় বেহালার বিষাদ রাগলহরীগুলো ক্রুশাকারে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের প্রতিটি গ্রন্থিতে

অবিরল কাকডাকা দুপুরে অঙ্ক কষার স্মৃতি, নির্বান্ধব কুয়াশার মাঠে গাছের মর্মর শব্দের স্মৃতি, অপরিচিতার ওষ্ঠে চকিত হাসির স্মৃতি, লাজুক গোপনীয়তার স্মৃতি।
বিগত সময় ছুঁয়ে ছুঁয়ে চোখ আটকায় বাপির দেওয়া পেনটায়। 


কালচে লাল রঙের কালি পেন। সচরাচর যে মাপের পেন পাওয়া যায় তার থেকে কিছুটা বড়। ঢাকার মাথার দিকটায় কালো জমিতে সোনালী জরির নকশা। নিচের দিকেও তাই। সোনালী সরু নিব। ঝরঝর করে লেখে। পেনটা পেয়েছিলাম ক্লাস ফাইভ এ,  ফার্স্ট হওয়ার জন্য। তখন সবে পেন্সিল থেকে পেনে হাতেখড়ি। সকাল-দুপুর হাতময় কালি। লেখার চোটে একের পর এক বঙ্গলিপি খাতা শেষ। 

জানলার ওপারে আসন্ন সন্ধার আকাশে ছবি এঁকে উড়ে গেল এক সারি রাতচরা পাখি।

পেনটাকে নয়, মনে মনে বাপিকে স্পর্শ করলাম। বাপির সস্নেহ হাত চুল ছুঁয়ে গেল।

কত নিবিড় স্মৃতি বাপিকে ঘিরে। স্পষ্ট মনে পড়ে, নিঝুম শীতের সন্ধা। আমি আর দাদা মাদুরে বসে দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করছি। ঘুমে জড়িয়ে আসছে  দু জোড়া চোখ। দরজার ওপার থেকে বাপির গলায় সোনা বলে ডাক। দাদা একছুটে সদর দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙে গলিতে। 
হিম সন্ধার অন্ধকারের ভেতর থেকে বাপি এগিয়ে আসছে, হাতে দুটো ভারী ব্যাগ। শরীরটা সামনের দিকে সামান্য নত। দাদা তাড়াতাড়ি একটা ব্যাগ বাপির হাত থেকে নিয়ে নিল। আমি দরজার ফ্রেম ধরে দাঁড়িয়ে। 
বাপি ধীরে কাছে এগিয়ে এলো, পকেট থেকে একটা চকোলেটের প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল, 
- "দুজনে ভাগ করে খাবে"।

রবিবার সকালবেলা। জ্যোত্স্নার মতো শীতের রোদ প্রশ্রয় পেয়ে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  বাপি রান্না করছে। হাফ হাতা ছাই-রঙা সোয়েটারে ঢাকা গা। একমনে কড়াইয়ের দিকে চেয়ে আছে। উনুনে অড়হর ডাল চড়েছে। তখনও গোবিন্দভোগ চালের ভাত, পাঁপড় স্যাঁকা বাকি। বাড়িময় ম ম করছে আফগানী হিং এর গন্ধ। রেডিওতে পি. সি. চন্দ্র গ্রুপের নাটক। সবাই নির্বাক পাছে নাটকের সংলাপ ফসকে যায়। আমি কড়াইশুঁটি এটা ওটা হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বাপিকে দিচ্ছি। ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে ফুলের রেণুর মতন আলগা ভালোলাগা। 

অবশ্য সব স্মৃতিই ঝিলিমিলি ছায়ার নয়, রক্তিম আভাও তাতে আছে।
তবে সে গোধূলির কোমল লালবর্ণ, দ্বিপ্রহরের ঝাঁজ তাতে অনুপস্থিত।  


তারপর বহু শীত কেটে গেছে। আট হাজার মাইল পেছনে ফেলে এসেছি সেই বনস্পতির ছায়া। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। এ ঠান্ডার দেশ। ঘাসের জাজিমে সবুজ অস্তমিত| সবুজ পাতারাও ধীরে ধীরে রঙ বদ্লাচ্ছে| পাইন আর উইলো গাছগুলোকে একা রেখে শুধু ঝরে যাওয়ার অপেক্ষা। পড়ে থাকবে কেবল শোকার্ত তুষার। 

এমন এক গভীর রাতে তারাগুলো সবে রুপোর মুকুট খুলে শুতে গেছে, দাদার ফোন এলো। বাপি চলে গেছে। তারাগুলোর কাছে। কাল থেকে বাপিও মুকুট পরবে|


এতটা লিখে দেখছি, চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা শিশির জমেছে। 
অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বাপি চলে যাচ্ছে| দূরে, দূরে, অনেক দূরে| হাতে ধরা সেই ব্যাগ দুটো। এগিয়ে গিয়ে নেবার কেউ নেই।
বাপি এতটা পথ যেতে পারবে তো,
একা।

Tuesday, September 17, 2013

দি ফলিং ম্যান কে



এক।।
আলোর ওপারে নিঃসাড়ে স্থির ওরা জনা উনিশ। 
বজ্র মুঠি ছুরি, চোয়াল-কঠিন মন নিশপিশ। 
আদিম বই মানুষ শিকারে 
বেরিয়েছে আজ কদর্য বিচারে।
মানুষকে ভালবাসবে এটুকু ভালবাসা নেই যে বুকে, 
সে  কি করে ভালবাসবে বাহাত্তর অক্ষতযোনি যুবতীকে?

দুই।।
পেয়ালা-পিরিচে কলরব, সকাল নটায় 
পৌঁছতে হবে একশ তিন তলায়।
সন্তানের করমচার মতন রাঙা দুটি গাল,
প্রেমিকার আঙুলে আঙুল ছোঁয়া ভালবাসার কুহক জাল 
তাড়াহুড়োতে পেছনে ফেলে রেখে, বাঁচবে বলে 
লোকটা ঝাঁপ দিল অমরত্বের কোলে।

তিন।।
বিজ্ঞান প্লেন পাঠায় ছায়াপথে, 
ধর্ম ইমারতে।।

Thursday, September 12, 2013

ঠাকুমার ঝুলি






কানাডা। ১২ ই  সেপ্টেম্বর, ২০১৩।


সেদিন এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যেমনটি আজকাল আর সচরাচর ঘটে না। হিংসা আর পারস্পরিক সন্দেহে দীর্ণ এই আধুনিক পৃথিবীতে যা প্রায় রূপকথায় পর্যবসিত।

মুদির দোকানের জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরব।
হেমন্তের মড়া বিকেল। আকাশময় বিষন্নতা।
গোধুলির ক্ষীন আলোকে প্রায় মুছে ফেলে আকাশে বৃষ্টি-সম্ভবা মেঘেদের দ্রুত আনাগোনা।
ঝিরিঝিরি বইতে শুরু করলো তাদের ধারা। বর্ষাক্রান্ত বিকেলে এক গাদা জিনিসপত্র নিয়ে আমি বিহ্বল। ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষারত।
একা।

অপেক্ষা যেখানে শেষ; বিরক্তি আর উত্কন্ঠার যেখানে সূচনা, সময় সেখানে স্থির।

সহসা পেছন থেকে স্নিগ্ধ কোমল অচেনা গলায় চেনা ব্যাকুলতা, "তোমার ট্যাক্সি এখনো আসে নি?"
- "না, বেশ কিছুক্ষণ হলো, এই হয়ত এসে পড়বে", উত্তরে বললাম।

বয়স আনুমানিক নব্বইয়ের কোঠায়। মমতার পরশে আলোকিত মুখ, নির্ভার মন,  থুরথুরে এক মেমসাহেব ঠাকুমা।
হাজার হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা আর একটি স্নেহ-দ্রবীভূত মুখের কথা সহসা মনে করিয়ে দেয়।

- "চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই"।
পরের দুঃখে এমন কাতর হওয়া মানুষে অন্যভস্ত, বিড়ম্বিত আমি বলি, "না, আরেকটু বরং অপেক্ষা করি..."।

কিন্তু ঠাকুমা নাছোড়বান্দা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ইতিমধ্যে ঝমঝম রূপে আবির্ভূতা। অগত্যা আমি ঠাকুমার ডাকে সাড়া দি। তার চোখেমুখে নির্মল আনন্দের আভা। আমি বাক্যহীন, স্নেহের শিকলে আনন্দ-পরাহত।

কত কি কানে আসে এই ঘোলা সময়ে। কত নীচ, হীন ভাবনা নিজেরই অগোচরে এ মনে ঠাঁই পায়। চামড়ার রঙ, বিশ্বাসের ভিত্তি, আর অর্থের গরিমা মানুষে-মানুষে লড়াই বাঁধাচ্ছে। "সেইসব শেয়ালেরা" প্রতিদিন ছিঁড়ে খাচ্ছে মানব-হৃদয়। পৃথিবীর আজ গভীরতম অসুখ, এখানে ওখানে ছড়িয়ে পোড়া কাঠ-কয়লার মতন অজস্স্র কারণ। অথচ বৃষ্টি-স্নাত সেই সন্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কালো, বাদামী, আর সাদা রঙ সব মিশে গিয়ে যে রঙ প্রস্ফুটিত হলো তা কেবল সাদা।
অমলিন অন্তরের শুভ্রতা।

ছোটবেলায় পড়েছি সাদা রঙ নাকি সব রঙের মিশ্রণ।  তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাকি সব রঙটুকু। কালোটুকু ও।
নব্বই পেরোনো অপরিচিতা বিদেশিনী ঠাকুমা সেই শুভ্রতার অকপট প্রতীকমাত্র, এমন ক্ষয়িষ্ণু দিনেও তাই তার হাতে ধরা থাকে ভালবাসার ব্যাটন।