Sunday, November 3, 2013

না হওয়া কবিতা





মলিন একটা পাতা, একা তির তির করে কাঁপছে। হেমন্তের শেষ লগ্নে আর সবার মত ও ঝরে যায়নি। ঝরা, না ঝরা যে ওর হাতে নেই। এটুকু লিখে অস্বস্তি হোলো। মনে হলো, না না, আমি আসলে বলতে চাইছি পাতাটা বড় একা। স্বজনহারা পাতাটা ভীষণ দুঃখে আছে। পৃথিবীর যাবতীয় বিষন্নতা, নিঃসঙ্গতার পাষানভার বুকে ধরে পাতাটা সজল নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নির্বাক চিৎকারে ওর নগন্য শরীরে কাঁপন ধরছে। কিন্তু সেই কথাটা কি ভাবে লিখব বুঝতে না পেরে লিখলাম মলিন একটা পাতা, একা তির তির করে কাঁপছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন মনে হয়, কেন সোজাসুজি লিখতে পারছি না কথাটা? অক্ষরগুলো কি ভাবে সাজাব ভাবতে বসি। ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা জুড়ে আসে। ঘুমকে ঘুম পাড়িয়ে জানলার পাশে এসে বসি। রাত প্রায় বারোটা। মনে হচ্ছে পাতাটার দুঃখেই দরদি আকাশ আজ সারাদিন শোকগাথা গেয়েছে, অবিরত ঝরেছে তুষার। পথ-ঘাট ভরে গেছে নিহত সারসের পালকে। আসলে প্রতিটা তুষার-ফলকে আঁকা ছিল মনখারাপের উল্কি। চোখ খুলে ঘুমোই, তাই সঙ্কেতটা বুঝতে পারিনি। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় নিষ্পত্র গাছগুলো, আসমানের দিকে তাকিয়ে গাছগুলোর দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে দূরসম্পর্কীয় নক্ষত্রগুলো। 

একটা কালো কোট পরা কুঁজো লোক ছায়ার মন্তাজ তৈরী করতে করতে বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লোকটা যেন নির্জনতার উপনাম। সম্ভবত ঠান্ডা লাগলো লোকটার, কোটের শেষ বোতামটা লাগিয়ে নিল। হাতে সিগারেট জ্বলছে, নিভছে, আবার জ্বলে উঠছে, নিভছে দেরী করে। ঘন ঘন লম্বা টান দেখে বোঝা যায় লোকটারও পাতাটার মত তীব্র দুঃখ। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে নিঃসৃত বিষাদ কুন্ডলী পাকিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে হিম বাতাসে। সে বাতাস স্পর্শ করছে পাতাটার শিরা-উপশিরা। প্রতি মুহূর্তে এক গভীর আত্মীয়তা তৈরী হচ্ছে লোকটা আর পাতাটার মধ্যে। লোকটার ক্ষতের উপশম হচ্ছে। বিষাদ সাপের খোলসের মতন খসে পড়ছে, শিরদাঁড়া ক্রমশ ঋজু, লোকটার সেরে ওঠার শব্দ তিনশ মাইল দূরে ছড়িয়ে পড়ছে ... 

ওই পাতাটার, ওই লোকটার দুঃখাবসানের একজন সাক্ষী চাই, তাই আমি এই নিশুতি প্রহরে জানলায় বসে। আর কেউ নেই, অস্বচ্ছ কাঁচের মতন দৃষ্টি নিয়ে শুধু আমি। পৃথিবীর সমস্ত নিঃসঙ্গতার শেষ পরিনামের সাক্ষ্য বহন করার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত। এই কি আমার কাজ? নাম, অর্থ, যশ, আর নারীর জন্য অহরহ এক জুয়াখেলা চলছে চারপাশে, কেউ জিতছে, কেউ হারছে। ক্রমশ সবাই দূরে চলে যাচ্ছে, প্রতিমুহুর্তে সৃষ্টি হচ্ছে হাজারে হাজারে একসাথে একা মানুষ। এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল প্রতি সেকেন্ড স্পীডে আমার দিকে ছুটে আসছে কুঁজো লোকের পাল। তার আগে আমাকে খুঁজে বার করতে হবে এমন আরো কিছু জাদু-পাতা, পাহাড়ের চুড়ো থেকে হোক, সাগরের অতল থেকে হোক, প্রজাপতি মার্কা বুক পকেট থেকে হোক...।  আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি, মুখে হিম ঠান্ডার ঝাপটা লাগে, এখন আমি কাঁদতে পারি, আমার যাবতীয় দুঃখ ভাগ করে নিতে পারি ওইরকম আরেকটা পাতার সাথে। একটা না-ঝরা পাতা, নিশুতি জানলা, অবিশ্রান্ত তুষারের মায়াবী পতন,অচেনা লোকের চোখে আঁকা চেনা শান্তির রঙ, আমাকে ব্যাকুল করে তোলে। হাত দিয়ে স্পর্শ করি বরফ। খুঁড়তে থাকি, আমাকে ও পেতে হবে ওরকম আরো কিছু পাতা। হোক না ঝরে যাওয়া। এখনো হয়ত পচন ধরেনি। আমাকে খুঁড়ে যেতে হবে। মনে হয় ঠিক পেয়ে যাব। ঠিক পেয়ে যাব। 

2 comments: